ইসলাম শিক্ষা - Islamic Study

যাকাত

অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - ইসলাম শিক্ষা - Islamic Study - ইবাদাত | NCTB BOOK

প্রিয় শিক্ষার্থী, যাকাত ইসলামের মৌলিক পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম। এটি একটি আর্থিক ইবাদাত। আমরা পূর্বের শ্রেণিতে এ সম্পর্কে শিখেছি। এই অভিজ্ঞতায় আরো বিস্তারিত পরিসরে যাকাত ফরয হওয়ার শর্ত, যাকাতের ধর্মীয় গুরুত্ব, যাকাত আদায় না করার পরিণাম, যাকাতের নিসাব এবং যাকাত হিসাব করার নিয়ম সম্পর্কে জানব। চলো আমরা অভিজ্ঞতাটি শুরুর আগে যাকাত সংক্রান্ত একটি ইসলামি ঘটনা শুনি।

বাড়ির কাজ
তুমি যাকাত সংক্রান্ত যে ইসলামিক ঘটনা। গল্প শুনেহু বা জেনেছ তা পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য/সহপাঠীর সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় করো। ঘটনা/গল্পটি সংক্রান্ত তার/তাদের মতামত লিখে আনবে।

____________________________________________________________________________

যাকাত পরিচিতি

যাকাত অর্থ পবিত্রতা ও বৃদ্ধি। এছাড়া আধিক্য, বরকত ইত্যাদি অর্থেও যাকাত শব্দটি ব্যবহৃত হয়। যাকাত প্রদানের মাধ্যমে যাকাত প্রদানকারী ব্যক্তির মনের কলুষতা দূরীভূত হয় এবং তাঁর সম্পদও পবিত্র হয়। এ জন্য এর অর্থ পবিত্রতা। তাছাড়া যাকাত দানকারীর সম্পদে আল্লাহ তা'আলা বরকত দান করেন। যাকাত প্রদানের ফলে সমাজে ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং সমাজের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়। এভাবে যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদও বৃদ্ধি পায়। এজন্য যাকাতের অন্য অর্থ বৃদ্ধি।

ইসলামের পরিভাষায় ধনী ব্যক্তির সম্পদে দরিদ্র, অসহায়, গরীব, অভাবী ও নিঃস্ব ব্যক্তিদের আল্লাহ কর্তৃক সুনির্ধারিত যে অংশ রয়েছে, তা যথাযথভাবে আদায় করে দেওয়ার নামই যাকাত। যাকাত আদায়ের নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন- 

وَأَقِيمُوا الصَّلوةَ وَأتُوا الزَّكُوةَ 

অর্থ: 'আর তোমরা সালাত কায়েম কর এবং যাকাত প্রদান কর।' (সুরা আল-বাকারা, আয়াত: ৪৩)
মহানবি (সা.) বলেন-

أَدُّوا زَكُوةَ أَمْوَالِكُمْ

অর্থ: 'তোমরা তোমাদের মালের যাকাত প্রদান কর।' (তিরমিযি)

যাকাত ফরয হওয়ার শর্ত


নামাযের মতো যাকাতও মুসলিমদের জন্য ফরয। কিন্তু সকলের উপর যাকাত বাধ্যতামূলক নয়। বরং যাকাত ফরয হওয়ার জন্য কতিপয় শর্ত রয়েছে। যাকাত ফরয হওয়ার শর্তগুলো নিম্নরূপ:
১. মুসলমান হওয়া: যাকাত ফরয হওয়ার প্রথম শর্ত হলো মুসলমান হওয়া। কারণ যাকাত একটি ইবাদত। আর কাফির বা অমুসলিমের পক্ষ থেকে ইবাদত সাব্যস্ত হতে পারে না। তাই অমুসলিমের উপর যাকাত ফরয নয়। কোনো ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করলে তবেই তাকে যাকাত দিতে হবে। মু'আয ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে ইয়ামেন পাঠালেন ও বললেন, 'নিশ্চয়ই তুমি কিভাবধারী সম্প্রদায়ের কাছে যাত্রা করছ। সুতরাং তুমি তাদেরকে এই কথার প্রতি আহ্বান জানাবে যে, তারা সাক্ষ্য দেবে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং আমি আল্লাহর রাসুল। যদি তারা ঐ প্রস্তাব গ্রহণ করে নেয়, তাহলে তাদেরকে জানিয়ে দেবে যে, আল্লাহ তা'আলা তাদের প্রতি দিবারাত্রে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন। যদি ভারা এ কথাটিও মেনে নেয়, তাহলে তাদেরকে অবহিত করবে যে, মহান আল্লাহ তাদের (ধনীদের) উপর যাকাত ফরয করেছেন, যা তাদের ধনী ব্যক্তিদের নিকট থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তাদের গরীব মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হবে।' (বুখারি ও মুসলিম)
২ নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া: নিসাব পরিমাণ সম্পদ অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা সমমূল্যের সম্পদ থাকলে যাকাত ফরয হয়। কোনো মুসলিম ব্যক্তির নিকট নিসাব পরিমাণ সম্পদ না থাকলে তার উপর যাকাত ফরয হবে না। কারণ রাসুলুল্লাহ (সা) এ পরিমাণ সম্পদকে যাকাত ফরয হওয়ার কারণরূপে নির্ধারণ করেছেন। (হিদায়া)
৩. নিসাব পরিমাণ সম্পদ প্রকৃত প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া: নিজের পরিবারের জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য যেমন: খাদ্যসামগ্রী, পোশাক-পরিচ্ছদ, ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, যানবাহন, কৃষি কাজের উপকরণ, শিক্ষাসামগ্রী ইত্যাদি ব্যতীত অবশিষ্ট সম্পদ নিসাব পরিমাণ হতে হবে। সারা বছর এসব মৌলিক প্রয়োজন মিটানোর পর যে সম্পদ উদ্বৃত্ত থাকবে, শুধু তার উপর যাকাত ফরয হবে।
৪. ঋণগ্রস্ত না হওয়া: ঋণমুক্ত হওয়া যাকাত ফরয হওয়ার অন্যতম শর্ত। কোনো ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির উপর যাকাত ফরয নয়। তবে ঋণ পরিশোধের পর যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে তাহলে অবশ্যই তাকে অবশিষ্ট সম্পদের যাকাত প্রদান করতে হবে। নিজ ও পরিবারের প্রয়োজন পূরণের জন্য বাধ্য হয়ে যে ঋণ নেওয়া হয়, তার সমপরিমাণ সম্পদ বাদ দিয়ে যাকাতের হিসাব করতে হবে। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ উন্নয়নের জন্য যে ঋণ নেওয়া হয়, যেমন: কল-কারখানা বানানো, ভাড়া দেওয়া বা বিক্রি করার উদ্দেশ্যে বাড়ি বানানো অথবা অন্য যে কোনো ধরনের ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ঋণ নিলে যাকাত হিসাবের সময় সে ঋণ ধর্তব্য হবে না। এ ধরনের ঋণের কারণে যাকাত কম দেওয়া যাবে না। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক)

৫. সম্পদ এক বছর স্থায়ী হওয়া: নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর নিজ আয়ত্তাধীন থাকা যাকাত ফরয হওয়ার অন্যতম শর্ত। তাই নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর কাল স্থায়ী না হলে তার উপর যাকাত ফরয হবে না। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, 'বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কোনো সম্পদের যাকাত নেই।' (ইবন মাজাহ) তবে কৃষিজাত ফসল, খনিজদ্রব্য ইআদির যাকাতের ক্ষেত্রে এ শর্ত প্রযোজ্য নয়।
৬. জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া: যাকাত ফরয হওয়ার অন্যতম শর্ত বিবেকবান ও জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া। বিবেক- বুদ্ধিহীন পাগলের উপর উপর যাকাত ফরয নয়।
৭. বালেগ হওয়া: যাকাতদাতাকে অবশ্যই বালেগ বা প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। বালেগ হওয়ার আগে তার উপর যাকাত ফরয হবে না।
৮. স্বাধীন হওয়া: যাকাত প্রদানকারী ব্যক্তিকে স্বাধীন বা মুক্ত হতে হবে। পরাধীন ব্যক্তি বা দাস-দাসীর উপর যাকাত ফরয নয়।
এছাড়া যাকাত ফরয হওয়ার জন্য যাকাতের সম্পদ বর্ধনশীল হওয়া এবং সম্পদের উপর মালিকের পূর্ণ মালিকানা থাকা আবশ্যক।

দলীয় কাজ
'আমার উপর যাকাত ফরয হলে কেন আমি/আমরা সঠিক নিয়মে যাকাত আদায় করবো' (উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে তুমি/তোমরা কেন যাকাত প্রদান করবে (ফরয হলে) এ সম্পর্কে তোমার নিজস্ব ভাবনা লিখে উপস্থাপন করো।)

যাকাতের ধর্মীয় গুরুত্ব

যাকাত মুসলমানদের জন্য অবশ্য পালনীয় ইবাদাত। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে এটি তৃতীয় স্তম্ভ। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি। যথা-
১. আল্লাহ ছাড়া ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসুল-এ কথার সাক্ষ্য দান করা;
২. সালাত কায়েম করা;
৩. যাকাত প্রদান করা;
৪. হজ করা এবং
৫. রমযানের সিয়াম পালন করা। (বুখারি) 

প্রত্যেক সামর্থ্যবান স্বাধীন মুসলমান নর-নারীকে যাকাত প্রদান করতে হয়। যাকাত প্রদান করলে আল্লাহ তা'আলা তার সম্পদে বরকত দান করেন এবং এর বিনিময়ে আখিরাতে তাকে অফুরন্ত কল্যাণ প্রদান করবেন। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ পাক বলেন, 'হে বনি আদম। আমার পথে খরচ করতে থাকো। আমি আমার অফুরন্ত ভান্ডার থেকে তোমাদের দিতে থাকবো।' (বুখারি ও মুসলিম)।

কুরআনের অসংখ্য স্থানে নামাযের সাথে সাথে সমান গুরুত্ব দিয়ে যাকাত প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যার ওপর যাকাত ফরয হয়েছে, তাকে অবশ্যই যাকাত আদায় করতে হবে। হযরত আবু বকর (রা.) যাকাত আদায়ের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। তিনি যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। কেউ এই ফরযকে অস্বীকার করলে সে কাফির হয়ে যায়। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন,

وَوَيْلٌ لِّلْمُشْرِكِينَ الَّذِينَ لَا يُؤْتُونَ الزَّكُوةَ

وَهُمْ بِالْآخِرَةِ هُمْ كَفِرُونَ 

অর্থ: 'মুশরিকদের জন্য শুধুই ধ্বংস, যারা যাকাত আদায় করে না, তারা আখিরাতেও অবিশ্বাসী (কাফির)।' (সুরা হা-মিম আস সাজদাহ, আয়াত: ৬-৭)

মানুষ তার সম্পদকে বেশি ভালোবাসে। এজন্য মানুষ সম্পদ আহরণের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে। তাই মুমিন ব্যক্তিকে আল্লাহ তা'আলা তার প্রিয় ধন-সম্পদের মাধ্যমে পরীক্ষা করেন। আল্লাহ দেখতে চান যে, কে তাঁর আনুগত্য করে এবং কে অবাধ্য হয়। আল্লাহ তা'আলা ঘোষণা করেছেন, 'নিশ্চয় তোমাদের ধন-সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ'। (সুরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ১৫) মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য সেই সম্পদকে দান করে থাকে।

যাকাত প্রদানের উদ্দেশ্য কেবলমাত্র সাহায্য-সহযোগিতা নয়। এর উদ্দেশ্য হলো মানুষের মনকে পরিশুদ্ধ করা। একজন মুসলিম স্বেচ্ছায় যাকাত প্রদান করার মাধ্যমে তার ধন-সম্পদের জন্য আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এর ফলে তার মনে ভালোবাসা জন্মায় এবং সে আত্মিক শান্তি পায়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'তাদের সম্পদ হতে 'সাদাকা' গ্রহণ করুন। এর দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন। আপনি তাদের জন্য দোয়া করবেন। আপনার দোয়া তো তাদের জন্য চিত্ত স্বস্তিকর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।' (সুরা আত- তাওবা, আয়াত: ১০৩)

দলগত কাজ
'যাকাত প্রদান করলে আল্লাহ তা'আলা তার (যাকাত প্রদানকারীর) সম্পনে বরকত দান করেন' (উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক দলে বিভক্ত হয়ে দলে/প্যানেলে উপস্থাপনা করো।)

যাকাত আদায় না করার পরিণাম

যাকাত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য অবশ্যপালনীয় নির্দেশ। যাকাত আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্যকর্তব্য। যাকাত প্রদানকারীকে আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে অফুরন্ত কল্যাণ দান করবেন। আর যাকাত অস্বীকারকারীর জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা।

যে ব্যক্তি যাকাত অস্বীকার করে এবং যাকাত আদায় করে না, সে মহাপাপী। এ জন্য তাকে জাহান্নামের কঠোর শান্তি ভোগ করতে হবে। এ মর্মে আল্লাহ তা'আলা বলেন-

وَالَّذِينَ يَكْبَرُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا

فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ 

অর্থ: 'যারা স্বর্ণ-রৌপ্য জমা করে রাখে এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, আপনি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দিন'। (সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৩৪)
আল্লাহ তা'আলা আরো বলেন, 'সেদিন জাহান্নামের আগুনে তা গরম করা হবে এবং তা দিয়ে তাদের কপালে, পাঁজরে ও পিঠে দাগ দেওয়া হবে এবং তাদেরকে বলা হবে, এগুলোই সে সমস্ত সোনা-রূপা, যা তোমরা জনা করতে। কাজেই তোমরা যা জমা করেছিলে তার স্বাদ ভোগ কর'। (সুরা আত-তওবা, আয়াত: ৩৫)

এ আয়াতে যাকাত প্রদান না করার যে কঠোর শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তার এ শাস্তি তারই অর্জন। যাকাত না দিয়ে সম্পদ জমা করে রাখলে, সে সম্পদই তার জন্য কিয়ামতের দিন আযাবের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এ আয়াতে কপাল, পাঁজর ও পিঠ দন্ধ করার কথা এজন্য উল্লেখ করা হয়েছে যে, কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহর পথে খরচ করতে চায় না, তার কাছে যখন কোনো তিচ্ছুক কিছু চায়; কিংবা যাকাত প্রত্যাশা করে, তখন সে প্রথমে ভ্রকুঁচকে ফেলে, তারপর পাশ কাটিয়ে তাকে এড়িয়ে যেতে চায়। এতেও সে ক্ষান্ত না হলে তাকে পিঠ দেখিয়ে চলে যায়। এজন্য বিশেষ করে এ তিন অঙ্গে আযাব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। (কুরতুবি)

রাসুলুল্লাহ (সা.) যাকাত আদায় না করার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে মুমিনদেরকে বারবার সতর্ক করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'সোনা-রূপার অধিকারী যেসব লোক এর হক (যাকাত) আদায় করে না, কিয়ামতের দিন তার ঐ সোনা-রূপা দিয়ে তার জন্য আগুনের বহু পাত তৈরি করা হবে। অতঃপর সেগুলোকে জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে। তা দিয়ে তার ললাট, পাঁজর ও পিঠে দাগ দেওয়া হবে। যখনই সে পাত ঠান্ডা হয়ে আসবে, পুনরায় তা উত্তপ্ত করা হবে। আর তার সাথে এরূপ করা হবে এমন এক দিন, যার পরিমাণ হবে ৫০ হাজার বছরের সমান। তার এমন শাস্তি মানুষের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকবে। অতঃপর তাদের কেউ পথ ধরবে হয় জান্নাতের দিকে আর কেউ দোযখের দিকে।' (মুসলিম)

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে অপর এক বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যাকে আল্লাহ সম্পন দান করেছেন কিন্তু সে এর যাকাত আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে টেকো মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার মুখের দু'পাশে কামড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার জমাকৃত মাল।' (বুখারি)

রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন, 'যে ব্যক্তি নিজের উটের হক (যাকাত) আদায় করবে না, কিয়ামতের দিন সে উট দুনিয়ার চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে খুর দিয়ে আপন মালিককে পিষ্ট করতে থাকবে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি বকরির হক আদায় করবে না, সে দুনিয়ার চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে মালিককে খুর দিয়ে পদদলিত করবে এবং শিং দিয়ে আঘাত করবে।' (বুখারি)

যারা কৃপণতা করে যাকাত আদায় করে না, তাদের জন্য দুঃসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর নিকটবর্তী, জান্নাতের নিকটবর্তী, আল্লাহর বান্দাদের নিকটবর্তী এবং জাহান্নাম থেকে দূরবর্তী। অপরদিকে কৃপন ব্যক্তি আল্লাহ থেকে দূরে, আল্লাহর বান্দাদের থেকে দূরে এবং জাহান্নামের সন্নিকটে। আর একজন জাহিল দানশীল একজন কৃপণ আবেদ অপেক্ষা আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়'। (তিরমিযি)
সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিতকরণের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে যাকাত। তাই আমাদের কর্তব্য হলো নিজে যাকাত প্রদান করা এবং অন্যকে যাকাত দানে উৎসাহিত করা। এভাবে সমাজের ধনী-গরীবের বৈষম্য কমে আসবে এবং শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা হবে।

দলগত কাজ
'প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলিমের উচিত সঠিক নিয়মে যাকাত প্রদান করা' (উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে তোমরা সঠিক নিয়মে যাকাত প্রদানের গুরুত্ব দলে আলোচনা করে উপস্থাপন করো।)

যাকাতের নিসাব

নিসাব )صاب( আরবি শব্দ। এর অর্থ নির্ধারিত পরিমাণ। শরিয়তের পরিভাষায় যাকাত ফরয হওয়ার জন্য সম্পদের নির্ধারিত পরিমাণকে নিসাব বলা হয়। অর্থাৎ 'নিসাব' হলো যাকাত ফরয হওয়ার জন্য সম্পদের নির্ধারিত নিম্নতম সীমা বা পরিমাণ। সারা বছর জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের পর বছর শেষে যার হাতে নিসাব পরিমাণ সম্পদ উদ্বৃত্ত থাকে তাকে সাহিবে নিসাব বা নিসাবের মালিক বলা হয়। আর সাহিবে নিসাবের উপরই যাকাত ফরয হয়।

নিসাবের পরিমাণ হলো, সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) কোলা রূপা (প্রায় ৬১৩ গ্রাম) বা সাড়ে সাত (৭.৫) ভোলা সোনা (প্রায় ৮৮ গ্রাম) বা এর সমমূল্যের সম্পদ। এই পরিমাণ নির্ধারণে ব্যক্তির সর্বমোট আয় থেকে যাবতীয় ব্যয় বাদ দেওয়ার পর উদ্বৃত্ত অর্থ এবং তার পূর্বের সঞ্চয় ও উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ যুক্ত হবে। নগদ অর্থ, ব্যাংকে জমাকৃত অর্থ এবং ব্যবসায়িক পণ্য, স্বর্ণ, রৌপ্য, শেয়ার, ব্যাংক নোট, স্টক, অংশীদারী কারবার, প্রভিন্ডেট ফান্ড প্রভৃতি সম্পদ যুক্ত করে যদি উক্ত নিসাব পরিমান সম্পদ হয় তাহলে তাকে ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে। তবে কৃষিজাত দ্রব্য, গবাদি পশু ও খনিজ সম্পদের যাকাতের নিসাব ও যাকাতের হার ভিন্ন ভিন্ন।

নিসাব পরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি সম্পদ কারো কাছে এক বছর কাল স্থায়ী থাকলে ঐ সম্পদের মূল্যের চল্লিশ ভাগের একভাগ যাকাত হিসাবে দেওয়া ফরয। শতকরা হিসাবে এর পরিমান হলো ২.৫%। কিন্তু সম্পদ নিসাব পরিমাণের কম হলে যাকাত দিতে হবে না। এক বছরকাল পূর্ণ না হলেও তার যাকাত নেই।

উৎপাদিত ফসল ও ফলের নিসাব

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে, ধান, গম, যবসহ অন্যান্য ফসল অল্প হোক বা বেশি, ভূমি থেকে উৎপাদিত সকল শস্যের উপর উশর ওয়াজিব হবে। তা প্রবাহিত পানি দ্বারা সিঞ্চিত হোক, কিংবা বৃষ্টির পানি দ্বারা সিঞ্চিত হোক। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর দলিল হলো, রাসুল (সা.) এর বাণী: বৃষ্টির পানি থেকে যা উৎপন্ন করে, তাতে উশর ওয়াজিব হবে। (মুসনাদে আহমদ)

আর ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদের মতে উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ ৫ ওয়াসাক হলে উশর ওয়াজিব হবে। এক ওয়াসাক হলো ৬০ সা এর সমপরিমাণ। এক সা হলো ৩২৭০.৬০ গ্রাম তথা ৩ কেজি ২৭০ গ্রামের কিছু বেশি। তাদের দলিল হলো রাসুল (সা.)-এর এই বাণী: 

لَيْسَ فِيمَا دُوْنَ خَمْسَةِ أَوْسُقٍ صَدَقَةٌ

অর্থ: পাঁচ ওয়াসাকের কম হলে যাকাত ওয়াজিব নয়। (মুসলিম)

খনিজ সম্পদের নিসাব

স্বর্ণ, রৌপ্য, লোহা, সীসা, কিংবা তামা প্রভৃতি খনিজ দ্রব্যের এক পঞ্চমাংশ অর্থাৎ শতকরা বিশভাগ (২০%) যাকাত দিতে হবে। মহানবি (সা.) বলেছেন-

وَفِي الرِّكَازِ الْخَمْسُ

অর্থ: 'ভূ-গর্ভস্থ সম্পদের উপর এক-পঞ্চমাংশ যাকাত ওয়াজিব।' (তিরমিযি)

গবাদি পশুর যাকাতের নিসাব

গরু, মহিষ, উট, ভেড়া, দুম্বা, ছাগল প্রভৃতি গবাদি পশুর নিসাবের পরিমাণ ও যাকাতের হারে ভিন্নতা রয়েছে। গরু বা মহিষ ৩০টি হলে; উট ৫টি হলে এবং দুম্বা, ছাগল বা ভেড়া ৪০টি হলে যাকাত ফরয হয়।

যাকাত হিসাব করার নিয়ম

যাকাত একটি আর্থিক ফরয ইবাদাত। বছরে একবার মালে নিসাবের অধিকারী ব্যক্তিকে যাকাত প্রদান করতে হয়। বছরের একটা নির্দিষ্ট দিন থেকে পরবর্তী বছরের ঐ নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত যাবতীয় আয়-ব্যয়ের হিসাব করে যাকাত প্রদান করতে হয়। এই দিন নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যে কোনো মাসের যে কোনো দিন নির্ধারণ করা যায়। সাধারণত হিসাব সংরক্ষণের সুবিধার্থে কেউ কেউ হিজরি বছরের প্রথম মাস মহররমের কোনো দিন নির্ধারণ করেন। আবার অনেকে বেশি সাওয়াবের আশায় রমযান মাসকে নির্ধারণ করে থাকেন। তবে যখন থেকে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে, তখন থেকেই যাকাতের বছর গণনা শুরু করতে হবে। যে মাস থেকেই হিসাব রাখা হোক না কেন, হিসাব রাখতে হবে অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে। সংরক্ষিত হিসাব অনুযায়ী নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর কাল স্থায়ী হলে যাকাত প্রদান করতে হবে; অন্যথায় নয়। যাকাত হিসাবের ক্ষেত্রে চন্দ্র বছরের হিসাব ধরা উত্তম।

কোনো ব্যক্তির যেদিন নিসাবের একবছর পূর্ণ হবে, সেদিন তার যাকাতযোগ্য যত সম্পদ আছে, সেগুলো তাকে একত্রে হিসাব করতে হবে। যেমন নগদ অর্থ, ব্যবসায়িক সম্পদ, স্বর্ণ-রৌপ্য, ব্যাংকে জমাকৃত টাকা ও অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ, প্রভিডেন্ট ফান্ডে জমাকৃত টাকা, সঞ্চয়পত্রসহ অন্যসব জমানো সম্পদ একত্রে করে টাকায় রূপান্তর করে যে পরিমাণ সম্পদ হবে তার উপর ৪০ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ ২.৫% হারে যাকাত প্রদান করতে হবে।

স্বর্ণ-রৌপ্য আলাদা আলাদা হিসাব করে যাকাতের নিসাব না হলে দুটোকে একত্র করে হিসাব করে নিসাব পরিমাণ হলে তার যাকাত প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে স্বর্ণ বা রৌপ্য যে দ্রব্যের বাজার মূল্য হিসাব ধরলে গরীব ও অসহায় লোকজন বেশি উপকৃত হবে, সে দ্রব্যের বাজার মূল্য হিসাব ধরতে হবে।

ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি মোট সম্পদ থেকে ঋণের সমপরিমাণ সম্পদ টাকা বাদ দিয়ে অবশিষ্ট সম্পদ যদি নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে তাকে অবশিষ্ট সম্পদের উপর যাকাত দিতে হবে। নিম্নের উদাহরণের মাধ্যমে আমরা ভালোভাবে যাকাতের হিসাব বুঝতে পারবো-

চলো, একটি উদাহরণের মাধ্যমে যাকাতের হিসাব দেখি:

বেগম তাহমিনা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক। নিসাব এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর বছর শেষে তাঁর নিকট নগদ অর্থ ৫৫,০০০ টাকা, ব্যবসায়িক সম্পদ ২৩০,০০০ টাকা, ব্যাংকে জমাকৃত ৩৫,০০০ টাকা এবং তার এ ভরি স্বর্ণ ও ১০ ভরি রৌপ্য রয়েছে। স্বর্ণের মূল্য ভরি প্রতি ৯০,০০০ টাকা এবং রূপার ভরি ১০,০০০ টাকা। এখন বেগম তাহমিনা কত টাকা যাকাত প্রদান করবেন?

বেগম তাহমিনার যাকাত দিতে হবে ৮,৯৫,০০০ টাকার ২.৫% হারে অর্থাৎ ২২,৩৭৫ টাকা (বাইশ হাজার তিনশত পচাত্তর টাকা মাত্র)।

জোড়ায়/দলীয় কাজ
করিম সাহেবের কাছে ৩ তোলা স্বর্ণ, ২০ তোলা রূপা এবং ৪ লাখ টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত রয়েছে। তোমরা শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক জোড়ায়/দলে আলোচনা করে করিম সাহেবের যাকাতের পরিমাণ নির্ণয় করো।

 

Content added || updated By

আরও দেখুন...

Promotion